> Evangelium Barnabes - The Gospel of Barnabas - Bangla Quran

Latest Posts

Post Top Ad

jeudi 29 octobre 2020

Evangelium Barnabes - The Gospel of Barnabas

(৬১-সফ:৬.)
টিকা:৮) এটি কুরআন মজীদের একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ আয়াত। ইসলাম বিরোধীরা এ আয়াত নিয়ে যেমন অনেক অপপ্রচার চালিয়েছে তেমনি জঘন্যতম বিশ্বাসঘাতকতার অপরাধও করেছে। কারণ এ আয়াতে বলা হয়েছে যে, হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম স্পষ্টভাবে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নাম উল্লেখ করে তাঁর আগমণের সুসংবাদ দিয়েছিলেন। তাই বিষয়টি সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা আবশ্যক।

একঃ এতে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পবিত্র নাম বলা হয়েছে ‘আহমাদ’। আহমাদ শব্দের দু’টি অর্থ। এক, আল্লাহর সর্বাধিক প্রশংসাকারী। দুই, সবচেয়ে বেশী প্রশংসিত অথবা আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে যে সবচেয়ে বেশী প্রশংসার যোগ্য। সহীহ হাদীসসমূহ থেকে প্রমাণিত যে এটি ছিল নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের একটি নাম। মুসলিম ও আবু দাউদ তায়ালিসীতে হযরত আবু মুসা আশ’আরী (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, নবী (সা.) বলেছেনঃ أَنَا مُحَمَّدٌ وَأَنَا أَحْمَدُ وَأَنَا الْحَاشِرُ ”আমি মুহাম্মাদ, আমি আহমাদ এবং আমি সমবেতকারী………………. হযরত যুবাইর ইবনে মুতয়িম থেকে ইমাম মালেক, বুখারী, মুসলিম, দরেমী, তিরমিযী এবং নাসায়ী একই বক্তব্য সম্বলিত অনেকগুলো হাদীস উদ্ধৃত করেছেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এই নামটি সাহাবীদের মধ্যেও পরিচিত ছিল। হযরত হাসসান ইবনে সাবেতের কবিতার একটি ছত্রে বলা হয়েছেঃ صَلَّى الْاِلَهُ وِمَنْ نَحِفُّ بِعَرْشِهِ , وَالطَّيِبُوْنَ عَلَى الْمُبَارَكِ اَحْمَدُ

“মহান আল্লাহ, তাঁর আরশের চারপাশে সমবেত ফেরেশতারা এবং সব পবিত্র সত্তা বরকত ও কল্যাণময় আহমাদের ওপর দরুদ পাঠিয়েছেন।”

এ বিষয়টি ইতিহাস থেকে প্রমাণিত যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নাম শুধু মুহাম্মাদ ছিল না বরং আহমাদও ছিল। আরবদের গোটা সাহিত্যে কোথাও এ কথার উল্লেখ নেই, নবীর(সা.) পূর্বে কারো নাম আহমাদ রাখা হয়েছিল। কিন্তু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পরে এত অধিক সংখ্যক লোকের নাম আহমাদ ও গোলাম আহমাদ রাখা হয়েছে যে, তা হিসেব করাও অসম্ভব। এর চেয়ে বড় প্রমাণ আর কি হতে পারে যে, নবুওয়াতের যুগ থেকে আজ পর্যন্ত সমগ্র উম্মাতের মধ্যে তাঁর এই পবিত্র নামটি সুপরিচিত ও সুবিদিত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নাম যদি আহমাদ না হয়ে থাকে তাহলে যারা তাদের ছেলেদের নাম গোলাম আহমাদ রেখেছে তারা তাদের ছেলেদেরকে কোন আহমাদের গোলাম হিসেবে আখ্যায়িত করেছিল?

দুইঃ যোহন লিখিত সুসমাচারে সাক্ষ্য দেয় যে, হযরত ঈসা মাসীহর আগমনের সময় বনী ইসরাঈল জাতি তিনজন মহাব্যক্তিত্বের আগমনের অপেক্ষায় ছিল। এক, মাসীহ, দুই, এলিয় (অর্থাৎ হযরত ইলিয়াসের পুনরায় আগমন) এবং তিন, “সেই নবী।” যোহনের সুসমাচারের ভাষা হলোঃ

“আর যোহনের (ইয়াহইয়া আলাইহিস সালাম) সাক্ষ্য এই,-যখন যিহুদিগণ কয়েকজন যাজক লেবীয়কে দিয়া যিরূশালেম হইতে তাঁহার কাছে এই কথা জিজ্ঞেস করিয়া পাঠাইল, ‘আপনি কে? ’তখন তিনি স্বীকার করিলেন, অস্বীকার করিলেন, না; তিনি স্বীকার করিলেন যে, আমি সেই খ্রীষ্ট নই। তাহারা তাঁহাকে জিজ্ঞেস করিল, তবে কি? আপনি কি এলিয়? তিনি বললেন আমি নই। আপনি কি সেই ভাববাদী? তিনি উত্তর করিলেন না। তখন তাহারা তাহাকে কহিল, আপনি কে? যাহারা আমাদিগকে পাঠাইয়াছেন, তাহাদিগকে যেন উত্তর দিতে পারি। আপনার বিষয়ে আপনি কি বলেন? তিনি কহিলেন, আমি “প্রান্তরে এক জনের রব, যে ঘোষণা করিতেছে, তোমরা প্রভুর পথ সরল কর” …………………তাহারা তাঁহাকে জিজ্ঞেস করিল, আপনি যদি সেই খ্রীষ্ট নহেন, এলিয়ও নহেন, সেই ভাববাদীও নহেন তবে বাপ্তাইজ করিতেছেন কেন? ( অধ্যায়-১, পদ ১৯ থেকে ২৫ )

এসব কথা স্পষ্টভাবে প্রমাণ করে যে, বনী ইসরাঈল হযরত ঈসা মাসীহ এবং হযরত ইলিয়াস ছাড়াও আরো একজন নবীর আগমণের প্রতীক্ষায় ছিল। হযরত ইয়াহইয়া সেই নবী ছিলেন না। সেই নবীর আগমণ সম্পর্কে আকীদা-বিশ্বাস বনী ইসরাঈল জাতির মধ্যে এতটা প্রসিদ্ধ ও সর্বজনবিদিত ছিল যে, তাঁকে বুঝানোর জন্য সেই নবী কথাটা বলাই যেন যথেষ্ট ছিল। পুনরায় একথা বলার আর প্রয়োজনই হতো না যে, তাওরাতের যার সুসংবাদ দেয়া হয়েছে। তাছাড়া এসব কথা থেকে এও জানা গেল যে, তিনি যে নবীর প্রতি ইঙ্গিত করেছিলেন তাঁর আগমনের বিষয়টি অকাট্যভাবে প্রমাণিত ছিল। কেননা, হযরত ইয়াইহিয়াকে যখন বিভিন্নভাবে প্রশ্ন করা হলো, তখন তিনি একথা বলেননি যে, তোমরা কোন নবী সম্পর্কে জিজ্ঞেস করছ, আর কোন নবী তো আসবেন না?

তিনঃ এবার সেই সব ভবিষ্যদ্বাণীর প্রতি একটু লক্ষ্য করুন যা যোহনের সুসমাচারের ১৪ থেকে ১৬ পর্যন্ত অধ্যায়ে একাধারে উদ্ধৃত হয়েছেঃ

“আর আমি পিতার নিকট নিবেদন করিব এবং তিনি আর এক সহায় তোমাদিগকে দিবেন, যেন তিনি চিরকাল তোমাদের সঙ্গে থাকেন; তিনি সত্যের আত্মা; জগত তাঁহাকে গ্রহণ করিতে পারে না; কেননা সে তাঁহাকে দেখেনা, তাঁহাকে জানেও না; তোমরা তাঁহাকে জান, কারণ তিনি তোমাদের নিকটে অবস্থিতি করেন ও তোমাদের অন্তরে থাকিবেন” (১৪: ১৬, ১৭)

“তোমাদের নিকটে থাকিতে থাকিতেই আমি এইসকল কথা কহিলাম। কিন্তু সেই সহায়, পবিত্র আত্মা, যাঁহাকে পিতা আমার নামে পাঠাইয়া দিবেন, তিনি সকল বিষয়ে তোমাদিগকে শিক্ষা দিবেন এবং আমি তোমাদিগকে যাহা যাহা বলিয়াছি, সে সকল স্মরণ করাইয়া দিবেন।” (১৪: ২৫, ২৬)।

“এর পর আমি তোমাদের সহিত আর অধিক করা বলিব না; করণ জগতের অধিপতি আসিতেছে, আর আমাতে তাহার কিছুই নাই। “( ১৪: ৩০ )

“যাঁহাকে আমি পিতার নিকট হইতে তোমাদের কাছে পাঠাইয়া দিব, সত্যের সেই আত্মা, যিনি পিতার নিকট হইতে বাহির হইয়া আইসেন-যখন সেই সহায় আসিবেন-তিনিই আমার বিষয়ে সাক্ষ্য দিবেন। “(১৫: ২৬)।

“তথাপি আমি তোমাদিগকে সত্য বলিতেছি, আমার যাওয়া তোমাদের পক্ষে ভাল, কারণ আমি না গেলে সেই সহায় তোমাদের নিকটে আসিবেন না। কিন্তু আমি যদি যাই, তবে তোমাদের নিকটে তাঁহাকে পাঠাইয়া দিব। “(১৬: ৭)।

“তোমাদিগকে বলিবার আমার আরও অনেক কথা আছে, কিন্তু তোমরা এখন সে সকল সহ্য করিতে পার না। পরন্তু তিনি, সত্যের আত্মা, যখন আসিবেন তখন পথ দেখাইয়া তোমাদিগকে সমস্ত সত্যে লইয়া যাইবেন; কারণ তিনি আপনা হইতে কিছু বলিবেন না কিন্তু যাহা শুনেন, তাহাই বলিবেন এবং আগামী ঘটনাও তোমাদিগকে জানাইবেন। তিনি আমাকে মহিমান্বিত করিবেন; কেননা যাহা আমার, তাহাই লইয়া তোমাদিগকে জানাইবেন। পিতার যাহা যাহা আছে সকলই আমার; এই জন্য বলিলাম, যাহা আমার, তিনি তাহাই লইয়া থাকেন ও তোমাদিগকে জানাবেইন। “( ১৬: ১২-১৫ )।

চারঃ বাইবেলের এসব উদ্বৃতির সঠিক অর্থ নিরূপণের জন্য সর্বপ্রথম জানা দরকার যে, হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম এবং তাঁর সমকালীন ফিলিস্তিনবাসীদের ভাষা ছিল আরামীয় ভাষায় সেই কথ্য রূপ যাকে সুরিয়ানী (প্রাচীন সিরীয় ভাষা) বলা হয়। ঈসা আলাইহিস সালামের জন্মের দুই আড়াই শত বছর পূর্বেই সালুকী (Seleucie) শাসন আমলে এ অঞ্চল থেকে ইব্রিয় বা হিব্রু ভাষা বিদায় নিয়েছিল এবং সুরিয়ানী ভাষা তার স্থান দখল করেছিল। যদিও প্রথমে সালুকী এবং পরে রোমান সাম্রাজ্যের প্রভাবে গ্রীক ভাষাও এ অঞ্চলে পৌঁছেছিল কিন্তু যে শ্রেণীটি সরকার ও রাজদরবারে স্থান করে নিয়েছিল কিংবা স্থান করে নেয়ার জন্য গ্রীক ভাবধারা পন্থী হয়ে গিয়েছিল কেবল তাদের মধ্যেই তা সীমাবদ্ধ ছিল। ফিলিস্তিনের সাধারণ মানুষ সুরিয়ানী ভাষার একটি বিশেষ কথ্য রূপ (dialect) ব্যবহার করত, যার ধ্বনি, কথনভঙ্গি, উচ্চারণরীতি এবং বাকধারা দামেশক অঞ্চলে প্রচলিত সুরিয়ানী ভাষারূপ থেকে ভিন্ন ছিল এবং এ দেশের সাধারণ মানুষ গ্রীক ভাষার সাথে এতটা অপরিচিত ছিল যে, ৭০ খৃস্টাব্দে যিরুশালেম দখলের পর রোমান জেনারেল টিটুস (Titus) যিরুশালেমের অধিবাসীদের সামনে গ্রীক ভাষায় বক্তৃতা করলে তা সুরিয়ানী ভাষায় অনুবাদ করতে হয়েছিল। এ থেকে আপনা আপনি প্রমাণিত হয় যে, হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম তাঁর শাগরিদদের যা বলেছিলের তা অবশ্যই সুরিয়ানী ভাষায় হবে।

দ্বিতীয় যে, বিষয়টি জানা জরুরী তা এই যে, বাইবেলের চারটি পুস্তক বা সুসমাচারই সেই সব গ্রীক ভাষাভাষী খৃস্টানদের লেখা যারা হযরত ঈসার পর এ ধর্ম গ্রহণ করেছিল। হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের বাণী ও কাজকর্মের বিস্তারিত বিবরণ তাদের কাছে সুরিয়ানী ভাষী কোন খৃস্টানদের মাধ্যমে লিখিত আকারে নয় বরং মৌখিক বর্ণনার আকারে পৌঁছেছিল এবং সুরিয়ানী ভাষার এই বর্ণনাসমূহকে তারা নিজেদের ভাষায় অনুবাদ করে লিপিবদ্ধ করেছিল। এসব পুস্তক বা সুসমাচারের কোনটিই ৭০ খৃস্টাব্দের পূর্বে লিখিত নয়। আর যোহন লিখিত সুসমাচার তো হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের একশত বছর পরে সম্ভবত এশিয়া মাইনরের এফসুস শহরে বসে লেখা। তাছাড়াও গ্রীক ভাষায় সর্বপ্রথম লিখিত সুসমাচারের মূল কোন কপিও সংরক্ষিত নাই। মুদ্রণযন্ত্র আবিষ্কারের পূর্বে গ্রীক ভাষায় লিখিত যেসব পাণ্ডুলিপি বিভিন্ন জায়গা থেকে খুঁজে খুঁজে এনে একত্রিত করা হয়েছিল তার কোনটিই চতুর্থ শতাব্দির পূর্বের নয়। তাই তিন শতাব্দীকাল সময়ে এসবের মধ্যে কি কি রদবদল এবং পরিবর্তন-পরিবর্ধন হয়েছে তা বলা মুশকিল। যে জিনিস এ বিষয়টিকে বিশেষভাবে সন্দেহজনক করে তোলে তা হলো, খৃস্টানরা তাদের পছন্দ মাফিক জেনে বুঝে তাদের সুসমাচারের পরিবর্তন ও পরিবর্ধনকে বৈধ মনে করে এসেছে। ইনসাইক্লোপেডিয়া ব্রিটানিকা (১৯৪৬ সনের সংস্করণে) এর বাইবেল শীর্ষক প্রবন্ধে প্রবন্ধের রচয়িতা লিখছেনঃ “বাইবেলের সুসমাচারসমূহে অনেক ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ বাক্য যা পদকেই অন্য কোন সূত্র থেকে এনে গ্রন্থের মধ্যে শামিল করার মত সুস্পষ্ট পরিবর্তন করা হয়েছে জেনে শুনে…………………. স্পষ্টত উদ্দেশ্যমূলকভাবে এসব পরিবর্তন সাধন করা হয়েছে। তা করেছে এমন সব লোক যারা মূল গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য কোন জায়গা থেকে কিছু তথ্য লাভ করেছে এবং গ্রন্থকে উন্নত ও অধিক কল্যাণকর বানানোর জন্য নিজের পক্ষ থেকে তার মধ্যে সেই সব তথ্য শামিল করার অধিকারী বলে নিজেদেরকে মনে করেছে…………………এরূপ বহুসংখ্যক সংযোজন দ্বিতীয় শতকেই হয়েছিল। কিন্তু তার উৎস সম্পর্কে জানা যায়নি। “

বর্তমানে বাইবেলের সুসমাচারসমূহে আমরা হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের যেসব বাণী দেখতে পাই তা সম্পূর্ণ নির্ভুল ও সঠিকভাবে উদ্ধৃত হয়েছে এবং তাতে কোন রদবদল ও পরিবর্তন পরিবর্ধন সাধিত হয়নি এমন কথা বলা উপরোক্ত পরিস্থিতির আলোকে নিশ্চিতভাবেই অত্যন্ত কঠিন।

তৃতীয় এবং সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, মুসলমানদের বিজয়ের পরেও প্রায় তিন শতাব্দীকাল পর্যন্ত ফিলিস্তিনের খৃস্টান অধিবাসীদের ভাষা ছিল সুরিয়ানী এবং খৃস্টীয় নবম শতকে গিয়ে আরবী ভাষা সে স্থান দখল করে। সুরিয়ানী ভাষাভাষী ফিলিস্তিনবাসীদের মাধ্যমে খৃস্টীয় ঐতিহ্য বা ধর্মাচারণ, আচার-অনুষ্ঠান ও ইতিহাস সম্পর্কে যেসব তথ্য প্রথম তিন শতাব্দীতে মুসলিম মনীষীগণ লাভ করেছিলেন তা সেই সব লোকদের লব্ধ তথ্যের তুলনায় অনেক বেশী নির্ভরযোগ্য হওয়া উচিত যা তাদের কাছে সুরিয়ানী থেকে গ্রীক এবং গ্রীক থেকে ল্যাটিক ভাষায় অনুবাদের পর অনুবাদ হয়ে পৌঁছেছিল। কেননা হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের মুখ থেকে উচ্চারিত মূল সুরিয়ানী শব্দসমূহ মুসলিম মনীষীদের কাছে সংরক্ষিত থাকার সম্ভাবনাই বেশী ছিল।

পাঁচঃ অনস্বীকার্য এসব ঐতিহাসিক সত্যের প্রতি লক্ষ্য করে দেখুন ওপরে উদ্ধৃত যোহন লিখিত সুসমাচারের পদগুলোতে হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম এমন একজন আগমনকারীর আগমনের সুসংবাদ দিচ্ছেন যিনি তাঁর পরে আসবেন। তিনি তাঁর সম্পর্কে বলেছেনঃ তিনি হবেন গোটা বিশ্বের নেতা (সরওয়ারে আলম), চিরকাল থাকবেন, সত্যের সবগুলো পথ দেখাবেন এবং নিজে তাঁর (হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম) সম্পর্কে সাক্ষ্য দিবেন। যোহন লিখিত সুসমাচারের এসব বাক্যের মধ্যে “পবিত্র আত্মা”এবং “সত্যের আত্মা” ইত্যাদি কথাগুলো অন্তর্ভুক্ত করে মূল বিষয় ও বক্তব্যকে বিকৃত করার পুরোপুরি চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও গভীর মনোযোগ সহকারে বাক্যগুলো পড়লে পরিষ্কার বুঝা যায় যে, যে আগমনকারীর আগমনের কথা বলা হয়েছে তিনি কোন আত্মা নন বরং মানুষ। তিনি এমন এক বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব যাঁর শিক্ষা হবে বিশ্বজনীন, সর্বব্যাপী এবং কিয়ামত পর্যন্ত স্থায়ী সেই বিশেষ ব্যক্তিকে বুঝানোর জন্য বাইবেলের বাংলা অনুবাদের ‘সহায়’ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে এবং যোহন লিখিত মূল সুসমাচারের গ্রীক ভাষার যে শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছিল সে ব্যাপারে খৃস্টানদের অনড় দাবী হচ্ছে, যে শব্দটি ছিল Paracletis কিন্তু শব্দটির অর্থ নিরূপণ খোদ খৃস্টান পণ্ডিতগণকে যথেষ্ট জটিলতার সম্মুখীন হতে হয়েছে। মূল গ্রীক ভাষায় Paraclet শব্দটির কয়েকটি অর্থ হয়। কোন স্থানের দিকে ডাকা, সাহায্যের জন্য ডাকা, ভীতি প্রদর্শন করা, সাবধান করা, উৎসাহিত করা, প্ররোচিত করা, আশ্রয় প্রার্থনা করা বা আবেদন নিবেদন করা এবং দোয়া করা। তাছাড়াও গ্রীক বাগবিধি অনুসারে শব্দটির অর্থ হয় সান্ত্বনা দেয়া, পরিতৃপ্ত করা, সাহস যোগানো। বাইবেলের যেসব জায়গায় এ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে সেসব জায়গায় এর কোন একটি অর্থও খাপ খায় না। ওরাইজেন( Origen ) কোথাও এর অনুবাদ করেছেন Consolator আবার কোথাও অনুবাদ করেছেন deprecator । কিন্তু অন্যান্য ব্যাখ্যাকারগণ এ দু’টি অনুবাদ প্রত্যাখ্যান করেছেন। কেননা প্রথমত গ্রীক ভাষার ব্যাকারণ অনুসারে এটি শুদ্ধ নয়।

দ্বিতীয়ত, সবগুলো বাক্যের যেখানে যেখানে এই শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে সেখানে এই অর্থ খাপ খায় না। আরো কিছু সংখ্যক অনুবাদক এর অনুবাদ করেছেন Teacher . কিন্তু গ্রীক ভাষার ব্যবহার রীতি অনুসারে এ অর্থও গ্রহণ করা যেতে পারে না। এর অনুবাদে তার তুলিয়ান এবং অগাষ্টাইন Advocate শব্দটিকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন। আরো কিছু সংখ্যক লোক Assistant , Comforter এবং Consoler ইত্যাদি শব্দ গ্রহণ করেছেন। (দেখুন ইনসাইক্লোপেডিয়া অব বাইবেলিক্যাল লিটারেচার, শব্দ-প্যারাক্লিটাস)। এখন মজার ব্যাপার হলো, গ্রীক ভাষাতেই অন্য একটি শব্দ আছে Perilytos যার অর্থ প্রশংসিত। এ শব্দটি সম্পূর্ণরূপে মুহাম্মাদ محمد শব্দের সামার্থক। উচ্চারণের ক্ষেত্রেও Periclytos এবং Periclytos এর মধ্যে বেশ মিল আছে। অসম্ভব নয় যে, যেসব খৃস্টান মহাত্মনরা তাদের ধর্মগ্রন্থসমূহে নিজেদের মর্জি ও পছন্দ মাফিক নির্দ্বিধায় পরিবর্তন পরিবর্ধন করতে অভ্যস্ত ছিলেন তারা যোহন কর্তৃক বর্ণিত ভবিষ্যদ্বাণীর এই শব্দটিকে নিজেদের আকীদা-বিশ্বাসের পরিপন্থী দেখতে পেয়ে তা লিপিবদ্ধ করার সময় কিছুটা রদবদল করে দিয়েছে। এ বিষয়টি যাঁচাই করার জন্য যোহন কর্তৃক লিখিত আদি গ্রীক ভাষায় সুসমাচার গ্রন্থ কোথাও বর্তমান নেই। তাই দু’টি শব্দের মধ্যে মূলত কোনটি ব্যবহার করা হয়েছিল তা অনুসন্ধান করে দেখার সুযোগ নেই।

ছয়ঃ কিন্তু যোহন কোন গ্রীক শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন তার ওপরে এ বিষয়ে চূড়ান্ত ফয়সালা নির্ভর করে না। কেননা তাও অনুবাদ। পূর্বেই আমরা উল্লেখ করেছি যে, ফিলিস্তিনের সুরিয়ানী ভাষা ছিল হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের ভাষা। তাই তিনি তাঁর সুসংবাদ বাণীতে যে শব্দ ব্যবহার করে থাকবেন তা অবশ্যই সুরিয়ানী ভাষারই কোন শব্দ হবে। সৌভাগ্যবশত আমরা সুরিয়ানী ভাষার সেই মূল শব্দটি পাচ্ছি ইবনে হিশামের সীরাত গ্রন্থে এবং তার সমার্থক গ্রীক শব্দটি কি তাও সাথে সাথে ঐ একই গ্রন্থ থেকে জানা যাচ্ছে। মুহাম্মাদ ইবনে ইসহাকের বরাত দিয়ে ইবনে হিশাম ইউহান্নাস (যোহন)-এর সুসমাচারের ১৫ অধ্যায়ের ২৩ থেকে ২৭ পদ এবং ১৬ অধ্যায়ের পুরো অংশের অনুবাদ উদ্ধৃত করেছেন এবং তাতে গ্রিক ভাষার فارقليط শব্দের জায়গায় সুরিয়ানী ভাষায় منحمنا শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। অতঃপর ইবনে ইসহাক অথবা ইবনে হিশাম এভাবে তার ব্যাখ্যা করেছেন যে, (منحمنا) (برقليطس) হয়। (ইবনে হিশাম, ১ ম খন্ড, পৃষ্ঠা ২৪৮)।

এখন দেখুন, ইতিহাস থেকে একথা প্রমাণিত যে, খৃস্টীয় নবম শতক পর্যন্ত ফিলিস্তিনের খৃস্টান জনগোষ্ঠীর ভাষা ছিল সুরিয়ানী। সপ্তম শতাব্দীর প্রথমার্ধ থেকেই এ অঞ্চল ইসলামবিজিত অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ইবনে ইসহাক ৭৬৮ খৃস্টাব্দে এবং ইবনে হিশাম ৮২৮ খৃস্টাব্দে ইনতিকাল করেন। এর অর্থ হলো, তাঁদের উভয়ের যুগেই ফিলিস্তিনের খৃস্টানরা সুরিয়ানী ভাষায় কথা বলত। আর ইবনে ইসহাক ও ইবনে হিশামের জন্য তাদের নিজ দেশের খৃস্টান নাগরিকদের সাথে যোগাযোগ বা সম্পর্ক স্থাপন মোটেই কোন কঠিন বিষয় ছিল না। তা ছাড়াও সে সময় লক্ষ লক্ষ গ্রীক ভাষা খৃস্টান ইসলামী ভূখণ্ডে বসবাস করত। তাই সুরিয়ানী ভাষার কোন শব্দ গ্রীক ভাষার কোন শব্দের সমর্থক তা চেনে নেয়াও তাদের জন্য কঠিন ছিল না। এখন কথা হলো ইবনে ইসহাকের উদ্ধৃত অনুবাদের যদি সুরিয়ানী শব্দ منحمنا মুনহামান্না ব্যবহৃত হয়ে থাকে আর ইবনে ইসহাক বা ইবনে হিশাম যদি তার ব্যাখ্যা এই করে থাকেন যে, আরবী ভাষায় তার সমার্থক শব্দ “মুহাম্মাদ” এবং গ্রীক ভাষায় “বারকালীতুস” তাহলে এ ব্যাপারে সন্দেহ পোষণ করার কোন অবকাশই আর থাকে না যে, হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সাল্লামের পবিত্র নাম নিয়েই তার আগমনের সুসংবাদ দিয়েছিলেন। সাথে সাথে একথাও জানা যায় যে, যোহন কর্তৃক গ্রিক ভাষায় লিখিত সুসমাচারে মূলত Periclytos শব্দটিই ব্যবহৃত হয়েছিল যা পরবর্তীকালে কোন এক সময়ে খৃস্টানরা পরিবর্তন করে Paracletus বানিয়ে দিয়েছে। সাতঃ এর চেয়েও প্রাচীন ঐতিহাসিক প্রমাণ হলো হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ একটি বর্ণনা। তাতে তিনি বলেছেন, নাজ্জাশী যখন তাঁর দেশ হাবশায় হিজরাতকারী মুহাজিরদের তাঁর দরবারে ডেকে পাঠালেন এবং হযরত জা’ফর ইবনে আবু তালিব রাদিয়াল্লাহু আনহুর মুখে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সাল্লামের শিক্ষাসমূহ সম্পর্কে শুনলেন তখন তিনি বলে উঠলেনঃ

مَرْحَباً بِكُمْ وَبِمَنْ جِئْتُمْ مِنْ عِنْدِهِ أَشْهَدُ أَنَّهُ رَسُولُ اللَّهِ وإِنَّهُ الَّذِى نَجِدُ فِى الإِنْجِيلِ وَإِنَّهُ الَّذِى بَشَّرَ بِهِ عِيسَى ابْنُ مَرْيَمَ (مسند احمد)

“স্বাগত জানাই তোমাদেরকে আর স্বাগত জানাই তাঁকেও যার নিকট থেকে তোমরা এসেছ। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, তিনি আল্লাহর রসূল। আর তিনিই সেই সত্তা যাঁর উল্লেখ আমরা ইনজীলে দেখতে পাই এবং তিনিই সেই সত্তা যার সুসংবাদ ঈসা ইবনে মারয়াম দিয়েছিলেন। “

বিভিন্ন হাদীসে এ কাহিনী খোদ হযরত জা’ফর (রা.) এবং হযরত উম্মে সালমা (রা.) কর্তৃক বর্ণিত হয়েছে। এ থেকে শুধু এ কথাই প্রমাণিত হয় না যে, সপ্তম শতাব্দির শুরুতে নাজ্জাশী জানতেন, হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম একজন নবীর আগমনের ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন। বরং একথাও প্রমাণিত হয় যে, বাইবেলের সুসমাচারে সেই নবীর এমন সব সুস্পষ্ট লক্ষণাদিরও উল্লেখ ছিল যার ভিত্তিতে হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামই যে সেই নবী সে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে নাজ্জাসী একটুও দ্বিধাগ্রস্ত হয়নি। তবে হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের এ সুসংবাদ সম্পর্কে নাজ্জাশীর জ্ঞানের সুত্র ও উৎস যোহন লিখিত এই সুসমাচার ছিল, না অন্য আর কোন উৎস ও সুত্র সে সময় বর্তমান ছিল, এ বর্ণনা থেকে তা জানা যায় না। আটঃ সত্য কথা হলো, খৃস্টান গীর্জাসমূহ কর্তৃক নির্ভরযোগ্য ও সর্বসমর্থিত ( CanonicalGospels ) বলে ঘোষিত চারখানি সুসমাচার যে কেবল রসূলুল্লাহ ﷺ সম্পর্কেই হযরত ঈসা (আ) ভবিষ্যদ্বাণীসমূহ জানার নির্ভরযোগ্য উৎস হতে পারে না, তাই নয় বরং তা খোদ হযরত ঈসা (আ) নিজের সঠিক জীবন বৃত্তান্ত ও শিক্ষাসমূহ সম্পর্কে অবগত হওয়ারও নির্ভরযোগ্য উৎস নয়। বরং তা জানার অধিক নির্ভরযোগ্য উৎস হচ্ছে বার্নাবাসের সেই সুসমাচার যাকে গীর্জাসমূহ বেআইনী ও অনিভরযোগ্য ( Apocryphal ) বলে উড়িয়ে দিয়ে থাকে। খৃস্টানরা তা গোপন করার যথেষ্ট চেষ্টা করেছেন। শত শত বছর পর্যন্ত তা লোকচক্ষুর অন্তরালে গোপন করে রাখা হয়েছিল। ইটালিয় ভাষায় অনূদিত এর একটি মাত্র কপি ষোড়শ শতাব্দিতে পোপ সিক্সটাসের ( Sixtus ) লাইব্রেরীতে পাওয়া যেত। কিন্তু তা পড়ার অনুমতি কারো ছিল না। অষ্টাদশ শতাব্দীর শুরুতে তা জন টোলেন্ড নামক এক ব্যক্তির হাতে আসে। অতঃপর বিভিন্ন হাত ঘুরে ১৭৩৮ খৃস্টাব্দে তা ভিয়েনার ইম্পেরিয়াল লাইব্রেরীতে পৌঁছে। ১৯০৭ খৃস্টাব্দে এ গ্রন্থের ইংরেজী অনুবাদ অক্সফোর্ডের ক্লোরিন্ডন প্রেস থেকে প্রকাশিত হয়েছিল। কিন্তু প্রকাশিত হওয়ার পর পরই সম্ভবত খৃস্টান জগত আঁচ করতে পারে যে, যে ধর্মকে হযরত ঈসার নামে নামকরণ করা হয় এ গ্রন্থ তারই মূলোৎপাটন করছে। তাই এর মুদ্রিত কপিসমূহ বিশেষ কোন ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে উধাও করে দেয়া হয়। এরপর তা আর কখনো প্রকাশিত হতে পারেনি। এ গ্রন্থেরই ইটালিয়ান ভাষার অনুবাদ থেকে স্প্যানিশ ভাষায় অনুদিত আরেকটি কপি অষ্টাদশ শতাব্দিতে পাওয়া যেত। জর্জ সেল তাঁর কুরআনের ইংরেজী অনুবাদের ভূমিকায় এ গ্রন্থের উল্লেখ করেছেন। কিন্তু সেটাও কোথাও গায়েব করে দেয়া হয়েছিল এবং বর্তমানে কোথাও তার সন্ধান পাওয়া যায় না। অক্সফোর্ড থেকে প্রকাশিত ইংরেজী অনুবাদের একটি ফটোষ্ট্যাট কপি দেখার সুযোগ আমার হয়েছে। আমি এর প্রতিটি শব্দ পড়েছি। আমার মনে হয়, এটা অতি বড় একটা নিয়ামত। খৃস্টানরা কেবল হিংসা-বিদ্বেষ ও হঠকারিতার কারণে এর থেকে নিজেদেরকে বঞ্চিত করে রেখেছে।

খৃস্টীয় সাহিত্যে যেখানেই এই ইনজিল বা সুসমাচারের উল্লেখ দেখা যায়, সেখানেই একথা বলে তা প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে যে, এটা কোন মুসলমানের রচিত নকল সুসমাচার যা বার্নাবাসের নামে চালিয়ে দেয়া হয়েছে। কিন্তু এটা একটা নির্জলা মিথ্যা কথা। এত বড় একটা মিথ্যা বলার কারণ এই যে, এ গ্রন্থে বিভিন্নস্থানে স্পষ্টভাবে নবী ﷺ সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী আছে। প্রথমত এই সুসমাচার গ্রন্থখানি পড়লে পরিষ্কার বুঝা যায় যে, এ গ্রন্থ কোন মুসলমানদের রচনা হতে পারে না। দ্বিতীয়ত, এ গ্রন্থ যদি কোন মুসলমানের রচিত হতো তাহলে মুসলমানদের মধ্যে তা ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ত এবং মুসলিম মনীষী ও পন্ডিতদের রচনায় ব্যাপকভাবে এর উল্লেখ থাকত। কিন্তু এক্ষেত্রে অবস্থা হলো জর্জ সেলের কোরআনের ইংরেজী অনুবাদের ভূমিকার পূর্বে এর অস্তিত্ব সম্পর্কেই মুসলমানদের আদৌ জানা ছিল না। তাবারয়ী, ইয়া’কূবী, মাস’উদী, আল বিরুনী ও ইবনে হাযম এবং অন্যান্য গ্রন্থকারগণ ছিলেন খৃস্টীয় সাহিত্য সম্পর্কে গভীর পান্ডত্যের অধিকারী মুসলিম মনীষী। তাদের কারো রচনাতেই খৃস্টান ধর্ম সম্পর্কিত আলোচনায় বার্নাবাসের সুসমাচারের আভাস-ইঙ্গিত পর্যন্ত পাওয়া যায় না। ইসলামী বিশ্বের গ্রন্থাগারসমূহে যেসব গ্রন্থরাজী ছিল ইবনে নাদীম রচিত “আল ফিহরিস্ত” এবং হাজী খলীফা রচিত “কাশফুয যুনুন” গ্রন্থেই তার ব্যাপক ও সর্বোত্তম তালিকা গ্রন্থ। এ দু’টি গ্রন্থেও তার কোন উল্লেখ নেই। ঊনবিংশ শতাব্দীর আগে কোন মুসলমান পণ্ডিতই বার্নাবাসের সুসমাচারের নাম পর্যন্ত উচ্চারণ করেননি। একথাটি মিথ্যা হওয়ার তৃতীয় এবং সর্বাপেক্ষা বড় প্রমাণ হলো, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্মেরও ৭৫ বছর আগে পোপ গ্লাসিয়াসের ( Gelasius ) যুগে খারাপ আকীদা ও বিভ্রান্তিকর ( Heretical ) গ্রন্থরাজির যে তালিকা প্রস্তুত করা হয়েছিল এবং পোপের দেয়া একটি ফতোয়ার জোরে যা পড়তে নিষেধ করা হয়েছিল তার মধ্যে বার্নাবাসের সুসমাচার (Evangelium Barnabes) গ্রন্থখানিও অন্তর্ভুক্ত ছিল। প্রশ্ন হলো, তখন মুসলমান এসেছিল কোথা থেকে যে এই নকল ইনজীল বা সুসমাচার রচনা করেছিল? খোদ খৃস্টান পন্ডিত পুরোহিতগণও একথা স্বীকার করেছেন যে, সিরিয়া স্পেন, মিসর, প্রভুতি দেশে প্রাথমিক যুগের খৃস্টান গীর্জাসমূহে দীর্ঘদিন পর্যন্ত বার্নাবাসের সুসমাচার প্রচলিত ছিল। কিন্তু পরবর্তী সময়ে ষষ্ঠ শতাব্দীতে এসে তা নিষিদ্ধ করে দেয়া হয়েছে।

নয়ঃ এই সুসমাচার থেকে নবী ﷺ সম্পর্কে হযরত ঈসার সুসংবাদসমূহ উদ্ধৃত করার আগে গ্রন্থখানির সংক্ষিপ্ত পরিচিতি তুলে ধরা প্রয়োজন যাতে তার গুরুত্ব সম্পর্কে সম্যক অবহিত হওয়া যায় এবং একথাও জানা যায় যে, খৃস্টানরা এর প্রতি এত মারমুখী কেন?

যে চারখানি সুসমাচারকে আইনসিদ্ধ ও নির্ভরযোগ্য বলে গ্রহণ করে বাইবেলের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে তার কোনটিরই লেখক হযরত ঈসা (আ) এর সাহাবী ছিলেন না। তাঁরা কেউ একথা দাবীও করেননি যে, তিনি হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের সাহাবীদের নিকট থেকে তথ্য নিয়ে তাঁর সুসমাচারে লিপিবদ্ধ করেছেন। যেসব উৎস থেকে তাঁরা তথ্য গ্রহণ করেছেন তার কোন বরাতও তারা উল্লেখ করেননি। যদি তাঁরা বরাত উল্লেখ করতেন তাহলে তা থেকে জানা যেতো যে, বর্ণনাকারী যেসব ঘটনা বর্ণনা করেছেন এবং যেসব বাণী উদ্ধৃত করেছেন তা তিনি নিজে দেখেছেন এবং শুনেছেন না একজন বা কয়েকজনের মাধ্যমে তা তাঁর কাছে পৌঁছেছে? পক্ষান্তরে বার্নাবাসের সুসমাচারের লেখক বলেছেন আমি হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের প্রথম বারজন হাওয়ারীর একজন। প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত আমি হযরত ঈসা মাসীহর সাথে ছিলাম এবং নিজের চোখে দেখা ঘটনা এবং নিজের কানে শোনা বাণী এ গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করেছি। শুধু এতটুকুই নয়, বরং গ্রন্থের শেষ পর্যায়ে তিনি বলেছেন, পৃথিবী থেকে বিদায় নেয়ার সময় হযরত মাসীহ আমাকে বলেছিলেনঃ আমার ব্যাপারে যেসব ভুল ধারণা মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে তা বিদূরিত করা এবং দুনিয়ার সামনে সঠিক অবস্থা তুলে ধরা তোমার দায়িত্ব।

কে ছিলেন এই বার্নাবাস? বাইবেলের “প্রেরিতদের কার্য” পুস্তকে এই নামের এক ব্যক্তির উল্লেখ বার বার এসেছে। এ ব্যক্তি ছিল সাইপ্রাসের এক ইহুদী পরিবারের লোক। খৃস্টান ধর্মের প্রচার এবং ঈসা মাসীহর অনুসারীদের সাহায্য-সহযোগিতার ক্ষেত্রে তার সেবা ও অবদানের অনেক প্রশংসা করা হয়েছে। কিন্তু কখন সে মাসীহর ধর্ম গ্রহণ করেছিল তা কোথাও বলা হয়নি এবং প্রাথমিক যুগের বারজন হাওয়ারীর যে তালিকা তিনটি সুসমাচারে দেয়া হয়েছে তার মধ্যে কোথাও তার নামের উল্লেখ নেই। তাই উক্ত সুসমাচারের লেখক সেই বার্নাবাস নিজে না অন্য কেউ তা বলা কঠিন। মথি এবং মার্ক হাওয়ারীদের ( Apostles ) নামের যে তালিকা দিয়েছেন বার্নাবাসের দেয়া তালিকা শুধু দু’টি নামের ক্ষেত্রে তাদের থেকে ভিন্ন। ঐ দু’টি নামের একটি হলো ‘তূমা’। এ নামটির পরিবর্তে বার্নাবাস নিজের নাম উল্লেখ করেছেন। দ্বিতীয়টি হলো, ‘শামউন কানানী’। এ নামটির পরিবর্তে তিনি ইয়াহুদা ইবনে ইয়া’কূবের নাম উল্লেখ করেছেন। লুক লিখিত সুসমাচারে এই দ্বিতীয় নামটিরও উল্লেখ আছে। তাই এরূপ ধারণা করা যুক্তিসঙ্গত যে, পরবর্তীকালে কোন এক সময় শুধু বার্নাবাসকে হাওয়ারীদের তালিকা থেকে বাদ দেয়ার জন্য তূমার নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে যাতে তার সুসমাচার গ্রন্থের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। আর নিজেদের ধর্মগ্রন্থসমূহে এ ধরনের রদবদল ও পরিবর্তন পরিবর্ধন করে নেয়া ঐ সব মহাত্মনদের দৃষ্টিতে কোন অন্যায় ও অবৈধ কাজ ছিল না।

কেউ যদি বার্নাবাসের এই ইনজীল বা সুসমাচার গ্রন্থখানি পক্ষপাত শূন্য ও বিদ্বেষমুক্ত মনে চোখ খুলে পড়ে এবং বাইবেল নতুন নিয়মের চারখানি সুসমারের সাথে তার তুলনা করে তাহলে সে একথা উপলব্ধি না করে পারবে না যে, এই গ্রন্থখানি উক্ত চারখানি গ্রন্থের চেয়ে অনেক উন্নত মানের। এতে হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের জীবনের ঘটনাবলী অধিক বিস্তারিতভাবে বর্ণিত হয়েছে এবং এমনভাবে বর্ণিত হয়েছে যেন কেউ প্রকৃতপক্ষে সেখানকার সবকিছু দেখছিল এবং নিজেও তাতে শরীক ছিল। চারখানি সুসমাচারের অসংবদ্ধ ও খাপ ছাড়া কাহিনীসমূহের তুলনায় এর ঐতিহাসিক বর্ণনা অধিক সুসংহত এবং ঘটনাসমূহের ধারাবাহিকতারও আরো ভালভাবে বোধগম্য। এতে হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের শিক্ষাসমূহ বাইবেলের চারখানি সুসমাচারের তুলনায় অধিক স্পষ্ট, বিস্তারিত এবং মর্মস্পর্শীরূপে বর্ণিত হয়েছে। এতে তাওহীদের শিক্ষা, শিরক খণ্ডন, আল্লাহ‌ তা’আলার গুণাবলী, ইবাদতের প্রাণসত্তা এবং উত্তম ও উন্নত চরিত্রের বিষয়াবলী অত্যান্ত জোরালো ভাবে যুক্তি ও প্রমাণসহ সবিস্তারে বর্ণিত হয়েছে। যেসব শিক্ষানীয় উপমা ও উদাহরণের মাধ্যমে মাসীহ আলাইহিস সালাম যেসব বিষয় বর্ণনা করেছেন, চারখানি সুসমাচারে তার ছিঁটেফোঁটাও নেই। তিনি কি ধরনের বিজ্ঞোচিত পন্থায় তাঁর শাগরিদদের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ দিতেন এ গ্রন্থ থেকে সে বিষয়টিও অধিক বিস্তারিতভাবে জানা যায়। হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের ভাষা, বাচনভঙ্গি এবং মেজাজ প্রকৃতি সম্পর্কে যার সামান্য পরিমাণও জ্ঞান আছে সে এই সুমাচার গ্রন্থখানি পাঠ করলে একথা স্বীকার না করে পারবে না যে, এটা পরবর্তীকালে কারো রচিত কোন নকল কাহিনী নয়। বরং চারখানি সুসমাচারের তুলনায় এতে হযরত ঈসা তার প্রকৃত মর্যাদায় অধিকতর স্পষ্ট হয়ে আমাদের সামনে ফুটে ওঠেন। তাছাড়া সুসমাচার চতুষ্টয়ে তাঁর বিভিন্ন বানীর মধ্যে যে বৈপরীত্য লক্ষ্য করা যায় এ গ্রন্থে তার নামগন্ধ পর্যন্ত নেই।

হযরত ঈসার জীবন ও শিক্ষা হিসেবে এ গ্রন্থে যা বর্ণিত হয়েছে তা সঠিক অর্থে একজন নবীর জীবন ও শিক্ষা বলেই মনে হয়। এতে তিনি নিজেকে একজন নবী হিসেবেই পেশ করেছেন। পূর্ববর্তী সমস্ত নবী এবং আসমানী কিতাবসমূহকে সত্য বলে ঘোষণা করেছেন। এতে তিনি পরিষ্কার ভাষায় বলেছেন যে, নবী-রাসূলের (আলাইহিমুস সালাম) শিক্ষা ছাড়া সত্যকে জানার জন্য কোন মাধ্যম নেই। যারা নবী-রাসূলের পরিত্যাগ করে তারা প্রকৃতপক্ষে আল্লাহকেই পরিত্যাগ করে। সমস্ত নবী-রাসূল তাওহীদ, রিসালাত ও আখেরাতের যে শিক্ষা দিয়েছেন তিনি হুবহু সেই শিক্ষাই দিয়েছেন। এ গ্রন্থে তিনি নামায, রোযা এবং যাকাতের শিক্ষা দিচ্ছেন। এ গ্রন্থে বার্নাবাস বহুস্থানে তাদের নামাযের যে উল্লেখ করেছেন তা থেকে জানা যায় যে, এই ফজর, যোহর, আসর, মাগরিব, এশা ও তাহাজ্জুদের সময়ই তারা নামায পড়তেন এবং সর্বদা নামাযের আগে অযু করতেন। নবী-রাসূলের মধ্যে থেকে হযরত দাউদ ও সুলায়মানকেও তিনি নবী বলে স্বীকৃতি দিতেন। অথচ ইহুদী ও খৃস্টানরা তাঁদেরকে নবীদের তালিকা থেকে বাদ দিয়ে রেখেছে। তিনি হযরত ইসমাঈলকেই ‘যাবীহ’ (যাঁকে হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম আল্লাহর নির্দেশে যবেহ করতে নিয়ে গিয়েছিলেন-অনুবাদক) বলে ঘোষণা করেন, একজন ইহুদী আলেমকে তিনি স্বীকার করান যে, প্রকৃতপক্ষে হযরত ইসমাঈল ছিলেন ‘যাবীহ’ কিন্তু বনী ইসরাঈলরা জোড়াতালি দিয়ে জোর করে হযরত ইসহাককে যাবীহ বানিয়ে রেখেছে। কুরআন মজীদে আখেরাত, কিয়ামাত, জান্নাত ও দোযখ সম্পর্কে যা বর্ণিত হয়েছে তাঁর শিক্ষাও প্রায় তার কাছাকাছি।

দশঃ বার্নাবাসের সুসমাচারে বিভিন্ন স্থানে রসূলুল্লাহ ﷺ সম্পর্কে স্পষ্ট সুসংবাদের উল্লেখ থাকার কারণে যে খৃস্টানরা এর বিরোধী তা নয়। কারণ নবীর ﷺ জন্মেরও বহু আগে তারা এ গ্রন্থকে প্রত্যাখ্যান করেছিল। তাদের উষ্মা ও অসন্তুষ্টির প্রকৃত কারণ উপলব্ধি করতে হলে বিষয়টি সম্পর্কে কিছুটা বিস্তারিত আলোচনা প্রয়োজন।

হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের প্রথম যুগের অনুসারীগণ তাঁকে কেবল একজন নবী হিসেবে স্বীকার করতেন, হযরত মূসার শরীয়াতের অনুসরণ করতেন, আকীদা-বিশ্বাস, হুকুম-আহকাম ও ইবাদত-বন্দেগীর ক্ষেত্রে নিজেদেরকে বনী ইসরাঈল জাতির অন্য সবার থেকে মোটেই আলাদা কিছু মনে করতেন না এবং ইহুদীদের সাথে তাদের বিরোধ ছিল শুধু এতটুকু যে, তাঁরা হযরত ঈসাকে ‘মাসীহ’ হিসেবে মেনে নিয়ে তার প্রতি ঈমান এনেছিলেন, কিন্তু ইহুদীরা তাকে মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানাতো। পরবর্তীকালে সেন্টপল এই দলে শামিল হলে সে রোমান, গ্রীক এবং অন্যন্য অ-ইহুদী ও অ-ইসরাঈল লোকদের মধ্যেও এ ধর্মের তাবলিগ ও প্রচার শুরু করে দেয় । এ উদ্দেশ্যে সে একে এমন একটি নতুন ধর্ম বানিয়ে ফেলে যার আকীদা-বিশ্বাস , মূলনীতি এবং হুকুম-আহকাম হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের পেশকৃত ধর্ম থেকে সম্পূর্ণ ভিন্নতর ছিল । এই ব্যক্তি হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের সাহচর্য আদৌ পায়নি । বরং তাঁর জীবদ্দশায় সে ছিল চরম বিরোধী এবং তাঁর পরেও কয়েক বছর পর্যন্ত সে তার ধর্ম অনুসারীদের চরম শত্রু ছিল । পরবর্তী সময়ে এই দলে শামিল হয়ে যখন সে একটি নতুন ধর্ম তৈরী করতে শুরু করে তখনও সে তার এ কাজের সামর্থনের হযরত ঈসার দেয়া কোন সনদ পেশ করেননি বরং নিজের ‘কাশফ’ ও ‘ইলহাম’ বা মনের স্বতষ্ফূর্ত সৎপ্রেরণার ভিত্তিতেই তা করেছে । নতুন এই ধর্ম রচনার ক্ষেত্রে তার উদ্দেশ্য ছিল , ধর্ম হবে এমন যা দুনিয়ার সমস্ত অ-ইহুদী( Gentile ) গ্রহণ করবে । সে ঘোষণা করলো, খৃস্টানরা ইহুদীদের শরীয়াতের সমস্ত বিধি-নিষেধ ও বাধ্য বাধকতা থেকে মুক্ত । সে পানাহারের ব্যাপারে হালাল ও হারামের সব বিধি-নিষেধ তুলে দিলো । সে খাতনার নির্দেশও বাতিল করে দিল অ-ইহুদীদের কাছে যা বিশেষভাবে অপছন্দনীয় ছিল॥ এমন কি সে মাসীহর” খোদায়ী, খোদার বেটা হওয়া এবং সমস্ত আদম সন্তানের জন্মগত পাপের কাফ্ফারা বা প্রায়শ্চিত্ত করার জন্য শূলিবিদ্ধ হয়ে জীবন দেয়ার আকীদ-বিশ্বাসও গড়ে নিল । কারণ তা সাধারণভাবে সমস্ত মুশরিকের মেজাজের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল । হযরত ঈসার(আ) প্রথম যুগের অনুসারীগণ এসব বিদ’আতের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ালেন কিন্তু সেন্টপল যে দরজা খুলে দিয়েছিল তা দিয়ে অ-ইহুদী খৃস্টানদের এক বিরাট সয়লাব এ ধর্মে ঢুকে পড়লো যার মোকিবিলায় ঐ নগণ্য সংখ্যক লোকগুলো কোনক্রমেই টিকে থাকতে পারলেন না । তা সত্ত্বেও তৃতীয় খৃস্টাব্দের শেষ ভাগ পর্যন্তও এমন বহুলোক ছিলো যারা হযরত ঈসার খোদা হওয়ার আকীদা-অস্বীকার করতো । কিন্তু চতুর্থ খৃস্টাব্দের প্রারম্ভে (৩২৫ খৃঃ) নিকিয়ার ( Nicaea ) কাউন্সিল পল প্রবর্তিত আকীদা-বিশ্বাসকে খৃস্টানদের সর্বসম্মত ধর্ম হিসেবে চূড়ান্তভাবে ঘোষণা করে । অতপর রোমান সাম্রাজ্য খৃস্ট ধর্ম গ্রহণ করে এবং কাইজার থিওডোসিয়াসের সময় খৃস্ট ধর্মই সাম্রাজ্যের সরকারী ধর্ম হিসেবে পরিগণিত হয় । এরপর এটা অতি স্বাভাবিক ব্যাপার যে , যেসব গ্রন্থ এ আকীদার পরিপন্থী তা পরিত্যক্ত ঘোষিত হবে এবং কেবল সেই সব গ্রন্থরাজী নির্ভরযোগ্য বলে গৃহীত হবে যা এই আকীদার সাথে সংগতিপূর্ণ । ৩৬৭ খৃস্টাব্দে এথানাসিয়াসের ( Athanasius ) এক পত্রের দ্বারা প্রথমবারের মত স্বীকৃত ও নির্ভরযোগ্য গ্রন্থরাজির একটি ঘোষনা দেয়া হয় । পরে ৩৮২ খৃস্টাব্দে পোপ ডেমাসিয়াসের ( damasius ) সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত একটি সম্মেলন তা অনুমোদন করে এবং পঞ্চম শতাব্দীর শেষ পর্যায়ে পোপ গেলাসিয়াস (Gelasius) এই গ্রন্থসমষ্টিকে স্বীকৃতি দেয়ার সাথে সাথে প্রত্যাখ্যাত গ্রন্থরাজীর একটি তালিকাও প্রস্তুত করেন । অথচ পল প্রবর্তিত যেসব আকীদা-বিশ্বাসকে ভিত্তি করে ধর্মীয় গ্রন্থসমূহের নির্ভরযোগ্য ও অনির্ভরযোগ্য হওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল সেসব আকীদা-বিশ্বাসের কোন একটিও হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম নিজে শিক্ষা দিয়েছিলেন বলে খৃস্টান পাদরী-পুরোহিতদের কেউ কখনো দাবী করতে পারেননি । বরং যে সুসমাচারগুলো নির্ভরযোগ্য গ্রন্থসমূহের অন্তর্ভুক্ত তার মধ্যেও হযরত ঈসার (আ) কোন বাণী থেকে ঐ সব আকায়েদের স্বপক্ষে কোন প্রমাণ পাওয়া যায় না ।

এসব অগ্রহণযোগ্য গ্রন্থের মধ্যে বার্নাবাসের সুসমাচারকে অন্তর্ভুক্ত করার কারণ হলো তা সরকারীভাবে গৃহীত খৃস্টাবাদের আকীদা-বিশ্বাসের সম্পূর্ণ বিরোধী ছিল । এ গ্রন্থ রচনার উদ্দেশ্য ও লক্ষ সম্পর্কে এর রচয়িতা গ্রন্থের শুরুতে বলছেনঃ যেসব লোক শয়তানের প্রতারণায় পড়ে ঈসাকে আল্লাহর পুত্র বলে । খাতনা করা অপ্রয়োজনীয় মনে করে এবং হারাম খাদ্যকে হালাল করে দেয়া তাদের ধ্যান-ধারণা সংশোধনের উদ্দেশ্যে পলও এসব প্রতারিতদের একজন । তিনি বলেছেনঃ হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম যখন পৃথিবীতে ছিলেন তখন তাঁর মু’জিযাসমূহ দেখে মুশরিক রোমার সৈন্যরা সর্বপ্রথম তাঁকে খোদা এবং কেউ কেউ খোদার পুত্র বলতে শুরু করে । অতপর বনী ইসরাঈলদের সর্বসাধারণের মধ্যেও এই ছোঁয়াচে রোগ ছড়িয়ে পড়ে । এতে হযরত ঈসা (আ) অত্যন্ত বিচলিত হয়ে পড়েলিন । তিনি অত্যন্ত কঠোরভাবে এই ভ্রান্ত আকীদা প্রত্যাখ্যান করলেন এবং যারা তাঁর সম্পর্কে এ ধরনের কথা বলতো তাদেরকে অভিশাপ দিলেন । অতপর এই আকীদার প্রতিবাদের জন্য তিনি তাঁর শাগরেদদের সমগ্র ইয়াহুদিয়ায় পাঠিয়ে দিলেন এবং যার থেকে এসব মু’জিযা প্রকাশ পাচ্ছে তাকে খোদা অথবা খোদার পুত্র ‘মনে করার ভ্রান্ত ও উদ্ভট ধারণা থেকে মানুষ যাতে বিরত থাকে সে জন্য যেসব মু’জিযা তাঁর নিজের থেকে প্রকাশ পেতো তাঁর দোয়ায় শাগরেদদের থেকেও সেসব মু’জিযা প্রকাশ করা হলো । এ ব্যাপারে তিনি হযরত ঈসার (আ) বক্তৃতাসমূহ বিস্তারিত উদ্ধৃতি করেছেন যাতে তিনি অত্যন্ত কঠোরভাবে এসব ভ্রান্ত আকীদার প্রতিবাদ করেছিলেন । আর এই গোমরাহী প্রসার লাভ করায় হযরত ঈসা (আ) কতটা বিচলিত ছিলেন, তাও তিনি এ গ্রন্থের স্থানে স্থানে বর্ণনা করেছেন । তাছাড়া বার্নাবাস পলের গড়া এ আকীদাও খন্ডন করেছেন যে, হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম ক্রুশে জীবন দিয়েছিলেন । তিনি নিজ চোখে দেখা যে অবস্থা বর্ণনা করেছেন তাহলো, যে সময় ইয়াহুদা ইহুদী পুরোহিতদের নেতার নিকট থেকে ঘুষ গ্রহণ করে হযরত ঈসাকে গ্রেফতার করানোর জন্য সৈন্যদের নিয়ে আসলো তখন আল্লাহ তা’আলার হুকুমে চারজন ফেরেশতা তাঁকে উঠিয়ে নিয়ে গেলেন এবং ইয়াহুদা ইসকার ইউতির আকৃতি ও কণ্ঠ অবিকল হযরত ঈসার আকৃতি ও কণ্ঠের মত করে দেয়া হলো । তাকেই শূলি বিদ্ধ করা হয়েছে, হযরত ঈসাকে (আ) নয় । এভাবে এই সুসমাচার গ্রন্থখানি পলের গড়াখৃস্টান ধর্মের মূল উটপাটিত করে ফেলেছে এবং কুরআনের বক্তব্যকে দৃঢ়ভাবে সমর্থন করেছে । অথচ এসব বক্তব্যের কারণেই কুরআন নাযিলের ১১৫ বছর আগে খৃস্টান পাদরীগণ তা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন ।

এগারঃ এ আলোচনা থেকে স্পষ্ট হয়ে যায় যে, বার্নাবাসের ইনজিল বা সুসমাচার প্রকৃতপক্ষে বাইবেলের চারটি সুমাচার থেকে অধিক নির্ভরযোগ্য সুসমাচার । এ গ্রন্থ হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের শিক্ষা, জীবন-চরিত, এবং বাণীসমূহ সঠিকভাবে তুলে ধরে । এটা খৃস্টানদের দুর্ভাগ্য যে, এ গ্রন্থের সাহায্যে নিজেদের আকীদা-বিশ্বাস শুধরে নেয়া এবং হযরত ঈসার (আ) মূল শিক্ষাসমূহ জানার যে সুযোগ তারা লাভ করেছিল শুধু জিদ ও হঠকারিতার কারণে তা থেকে তারা বঞ্চিত থেকে গেল । বার্নাবাস হযরত ঈসা (আ) থেকে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সম্পর্কে যেসব সুসংবাদ বর্ণনা করেছেন এখন তা আমরা দ্বিধাহীনভাবে এখানে উদ্ধৃত করতে পারি । এসব সুসংবাদের কোনটিতে হযরত ঈসা (আ) নবীর (সা) নাম উল্লেখ করেছেন, কোনটিতে ‘রসূলুল্লাহ’ বলেছেন, কোনটিতে তাঁর জন্য ‘মাসীহ’ শব্দ ব্যবহার করেছেন, কোনটিতে ‘প্রশংসার যোগ্য’( Admirable ) বলছেন আবার কোনটিতে স্পষ্টভাবে এমন শব্দ ব্যবহার করেছেন যা হুবহু لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ محمد رَسُولُ اللَّهِ এর সমার্থক । এখানে সবগুলো সুসংবাদবাণী উদ্ধৃত করা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয় । কারণ তা এত অধিক সংখ্যক এবং বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন ভঙ্গিতে পূর্বাপর প্রসংগে এসেছে যে তার সমন্বয়ে একখানি স্বতন্ত্র গ্রন্থই তৈরী হতে পারে । আমরা তার মধ্য থেকে নমুনা হিসেবে এখানে কয়েকটি বাণী উদ্ধৃত করেছিঃ

“সমস্ত নবী-যাঁদেরকে আল্লাহ দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন, যাঁদের সংখ্যা এক লাখ চুয়াল্লিশ হাজার-অস্পষ্ট ভঙ্গীতে কথা বলেছেন । কিন্তু আমার পরে সমস্ত নবী এবং পবিত্র সত্তাসমূহের জ্যোতি আসবেন যিনি নবীদের বলা কথার অন্ধকার দিকের ওপর আলোকপাত করবেন । কারণ তিনি খোদার রসূল । “(অধ্যায়-১৭)

“ফারিশী এবং লাবীরা বললোঃ যদি তুমি মাসীহও না হয়ে থাকো , ইলিয়াসও না হয়ে থাকো কিংবা অন্য কোন নবীও না থাকো তাহলে তুমি নতুন শিক্ষা দিচ্ছ কেন এবং নিজেকে মাসীহর চেয়ে বড় করেই বা পেশ করছো কেন? জবাবে ঈসা বললেনঃ আমার দ্বারা আল্লাহ যেসব মুজিযা দেখান তা প্রকাশ করে যে, আমি তাই বলি যা খোদা চান । অন্যথায় তোমারা যার কথা বলে থকো, প্রকৃতপক্ষে আমি নিজেকে তার সেই (মাসীহ) চেয়ে বড় করে পেশ করার যোগ্য নই । যাকে তোমরা মাসীহ বলে থাকো আমি তো খোদার সেই রসূলের মোজার গিরা বা তাঁর জুতার ফিতা খোলারও উপযুক্ত নই, যাঁকে আমার আগে সৃষ্টি করা হয়েছিলো, আমার পরে আসবেন এবং সত্যের বাণী নিয়ে আসবেন , যাতে তাঁর দীনের কোন সীমাবদ্ধতা না থাকে । “(অধ্যায়-৪২)

“আমি দৃঢ় বিশ্বাস নিয়ে তোমাদের বলেছি যেসব নবী এসেছেন তাঁরা সকলেই কেবল একটি মাত্র কওমের জন্য খোদার নির্দশন হিসেবে সৃষ্টি হয়েছিলেন । তাই যেসব লোকের জন্য তাঁদের পাঠানো হয়েছিল তাদের মধ্যে ছাড়া সেই সব নবীর বাণী আর কোথাও প্রচারিত হয়নি । কিন্তু আল্লাহর রসূল যখন আসবেন খোদা হয়তো তাঁকে নিজের হাতের মোহর দিয়ে পাঠাবেন এমনকি দুনিয়ার যেসব কওম তাঁর শিক্ষা লাভ করবে তাদেরকেই তিনি মুক্তি ও রহমত পৌঁছিয়ে দেবেন । তিনি খোদাহীন লোকদের ওপর কর্তৃত্ব নিয়ে আসবেন এবং এমনভাবে মুর্তি পূজার মুলোৎপাটন করবেন যে, শয়তান অস্থির হয়ে উঠবে । “

“এরপর শাগরেদদের সাথে দীর্ঘ কথাবার্তার সময় হযরত ঈসা (আ) স্পষ্ট করে একথা বলেন যে, সেই নবী হবেন বনী ইসমাঈল বংশের লোক”(অধ্যায়-৪৩)

“এ জন্য আমি তোমাদের বলি যে, খোদার রসূল এমন এক দীপ্তি ও সৌন্দর্য যার দ্বারা খোদা তা’আলার সৃষ্ট প্রায় সব বস্তুই আনন্দিত হবে । কেননা, তিনি উপলদ্ধি ও উপদেশ, বুদ্ধিমত্তা ও শক্তি , ভয় ও ভালবাসা এবং দূরদর্শিতা ও পরহেযগারীর প্রাণসত্তায় উজ্জীবিত । তিনি বদান্যতা ও দয়ামায়া , ন্যায় নিষ্ঠাতা ও তাকওয়া এবং শিষ্টাচার ও ধৈর্যের প্রাণসত্তা দ্বারা গুণান্বিত । আল্লাহ তাঁর সৃষ্টির মধ্যে যাদের এই প্রাণসত্তা দান করেছেন তিনি তাদের তুলনায় তা তিনগুণ লাভ করেছেন । যে সময় তিনি দুনিয়ায় আসবেন সে সময়টা কত বরকতপূর্ণ ও কল্যাণময় হবে । নিশ্চিতরূপে বিশ্বাস করো, যেমনটি প্রত্যেক নবী তাঁকে দেখেছেন তেমনি আমিও তাঁকে দেখেছি এবং সম্মান দেখিয়েছি । তাঁর রূহকে দেখেই আল্লাহ তাঁকে নবুওয়াত দিয়েছেন । আর আমি যখন তাঁকে দেখলাম তখন আমার প্রাণ একথা বলতে গিয়ে পরম প্রশান্তিতে ভরে উঠলো যে, হে মুহাম্মাদ , খোদা তোমাদের সাথে থাকুন এবং তিনি যেন আমাকে তোমার জুতার ফিতা বেঁধে দেয়ার যোগ্য বানিয়ে দেন । কারণ, এই মর্যাদাটুকু পেলেও আমি একজন বড় নবী এবং খোদার এক পবিত্র সত্তা হিসেবে পরিগণিত হবো” । (অধ্যায়-৪৪)

“(আমার চলে যাওয়ার কারণে) তোমাদের মন যেন বিচলিত না হয় এবং তোমরা ভয় না পাও । কারণ , আমি তোমাদের সৃষ্টি করি নাই । বরং আল্লাহ তা’আলা আমাদের স্রষ্টা , তিনিই তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন এবং তিনিই তোমাদেরকে রক্ষা করবেন । বাকী রইল আমার কথা । আমি এ সময় দুনিয়ায় এসেছি আল্লাহর সেই রাসূলের জন্য পথ পরিষ্কার করতে যিনি দুনিয়ার জন্য মুক্তি নিয়ে আসবেন…………. ইন্দিরিয়াস বললোঃ হে মহান শিক্ষাক, আমারা যাতে তাঁকে চিনতে পারি সে জন্য আপনি তাঁর কিছু নিদর্শন বলে দিন । ঈসা জবাব দিলেনঃ তিনি তোমাদের যুগে আসবেন না । বরং তোমাদের বহু বছর পরে আসবেন যখন আমার ‘ইনযিল’ এতটা বিকৃত হয়ে যাবে যে, বড় জোর ত্রিশজন ঈমানাদার অবশিষ্ট থাকবে । তখন আল্লাহ দুনিয়ার ওপরে অনুগ্রহ করবেন এবং তাঁর রাসূলকে পাঠাবেন । তাঁর মাথার ওপর সাদা মেঘ ছায়া দান করবে । তিনি যে, আল্লাহর মনোনিত তা এভাবে জানা যাবে এবং তাঁর দ্বারা দুনিয়া খোদার পরিচয় জানাতে পারবে । খোদাহীনদের বিরুদ্ধে তিনি বিরাট শক্তি নিয়ে আসবেন এবং পৃথিবী থেকে মুর্তিপূজা উচ্ছেদ করেবেন । তাঁর জন্য আমি খুবই আনন্দিত । কারণ তাঁর মাধ্যমে আমাদের খোদাকে চেনা যাবে, তাঁর পবিত্রতা প্রমাণিত হবে এবং সারা দুনিযা আমার সত্যতা জানতে পারবে । আর তিনি তাদের থেকে প্রতিশোধ নেবেন যারা আমাকে মানুষের চেয়ে বড় কিছু সাব্যস্ত করবে…………তিনি এমন একটি সত্য নিয়ে আসবেন যা সমস্ত নবী কর্তৃক আনীত সত্যের চেয়ে অধিক স্পষ্ট হবে । “(অধ্যায়-৭২)

“খোদার প্রতিশ্রুতি এসেছিল , যেরুশালেমে সুলায়ামানের উপাশনালয়ের মধ্যে অন্য কথাও নয় । কিন্তু আমার কথা বিশ্বাস করো, এমন এক সময় আসবে, যখন খোদা অন্য এক শহরে তাঁর রহমত নাযিল করবেন । অতপর সব জায়গায় সঠিকভাবে তাঁর ইবাদত বন্দেগী হতে পারবে । আর আল্লাহ তাঁর রহমতে সব জায়গায় সঠিক ও সত্যিকার নামায কবুল করবেন…………আমি প্রকৃতপক্ষে ইসরাঈলের পরিবারগুলোর জন্য ত্রাণকারী নবী হিসেবে প্রেরিত হয়েছি । কিন্তু আমার পরে সারা দুনিয়ার জন্য খোদার প্রেরিত সেই মাসীহ আসবেন যার জন্য আল্লাহ সারা দুনিয়া সৃষ্টি করেছেন । তখন সারা দুনিয়ায় আল্লাহর ইবাদত বন্দেগী হবে এবং তাঁর রহমত নাযিল হবে । “ (অধ্যায়-৮৩)

“(ঈসা পুরোহিত সর্দারকে বললেনঃ) জীবন্ত সেই খোদার শপথ, যাঁর জন্য আমার প্রাণ নিবেদিত । সারা বিশ্বের জাতিসমূহ যে মাসীহর আগমনের জন্য অপেক্ষা করছে, আমাদের পিতা ইবরাহীমকে (আ) আল্লাহ যাঁর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন এই বলে যে, তোমার বংশের মাধ্যমে পৃথিবীর সব জাতি আশীর্বাদ প্রাপ্ত হবে সে মাসীহ তো আমি নই । “ (আদিপুস্তকঃ অধ্যায়ঃ ২২ পদ-১৮)

“কিন্তু খোদা যখন আমাকে দুনিয়া থেকে নিয়ে যাবেন তখন শয়তান পুনরায় এভাবে বিদ্রোহ ছড়াবে যাতে খোদাকে যারা ভয় করে না তারা আমাকে খোদা এবং খোদার বেটা হিসেবে মেনে নেয় । তার কারণে আমার বাণী এবং শিক্ষা বিকৃত করে ফেলা হবে, এমনকি বড়জোর ত্রিশ জন ঈমানদার লোক অবশিষ্ট থাকবে । সেই সময় খোদা দুনিয়ার প্রতি অনুগ্রহ করবেন এবং তাঁর সেই রসূলকে পাঠাবেন যাঁর জন্য তিনি দুনিয়ার এই সব জিনিস সৃষ্টি করছেন । যিনি শক্তিতে বলিয়ান হয়ে দক্ষিণ থেকে আসবেন এবং মূর্তিসমূহকে মূর্তির পূজারীদের সহ ধ্বংস করে ফেলবেন । শয়তান মানুষের ওপর যে কর্তৃত্ব লাভ করেছে তিনি তার থেকে সে কর্তৃত্ব ছিনিয়ে নেবেন । যারা তাঁর ওপর ঈমান আনবে তাদের মুক্তির জন্য তিনি খোদার রহমত নিয়ে আসবেন । আর বড়ই সৌভাগ্যের অধিকারী তারা যারা তাঁর কাথা মানবে । “ (অধ্যায় ৯৬)

“পুরোহিত সদার জিজ্ঞেস করলোঃ খোদার সেই রাসূলের পরে অন্য কোন নবী কি আসবেন? ঈসা জবাব দিলেনঃ তাঁর পরে প্রেরিত আর কোন সত্যনবী আসবেন না । কিন্তু অনেক মিথ্যা নবী আসবে যে কারণে আমি দুঃখিত ও মনক্ষুণ্ন । কেননি খোদার ইসাফপূর্ণ ফায়সালার কারণে শয়তান তাদের আবির্ভাব ঘটাবে । তারা আমার এই ইনযীলের আড়ালে নিজেদেরকে লুকিয়ে রাখবে”(অধ্যায়-৯৭)



পুরোহিত সরদার জিজ্ঞেস করলোঃ সে মাসীহকে কোন নামে ডাকা হবে এবং কি কি নিদর্শন তাঁর আগমনকে প্রকাশ করবে? ঈসা জবাব দিলেনঃ সেই মাসীহর নাম ‘প্রশংসা যোগ্য’ । কেননা, আল্লাহ তা’আলা যখন তাঁর রূহ সৃষ্টি করেছিলেন , তখন নিজেই তার এ নাম রেখেছিলেন এবং সেখানে তাঁর ফেরেস্তাদের মত মর্যাদায় রাখা হয়েছিলো । খোদা বললেনঃ হে মুহাম্মাদ , অপেক্ষা কর । কেননা তোমার কারণেই আমি জান্নাত, পৃথিবী এবং আরো অনেক ‘মাখলুক’ সৃষ্টি করেবো । আর তা সব উপহার হিসেবে তোমাকে দেব । এমন কি যে তোমাকে মোবারকবাদ দেবে, তাকেও কল্যাণ দান করা হবে এবং যে তোমাকে অভিসম্পাত করবে তাকে অভিসম্পাত দেয়া হবে । যে সময় আমি তোমাকে দুনিয়ায় পাঠাবো তখন মুক্তির সংবাদ বাহক হিসেবে পাঠাবো । তোমার কথা হবে সত্য । আসমান ও যমীন স্থানচ্যুত হবে কিন্তু তোমার দীন টলবে না । তাই তাঁর পবিত্র ও কল্যাণময় নাম ‘মুহাম্মাদ’(সা) “(অধ্যায়-৯৭)

বার্নাবাস লিখছেনঃ এক সময়ে হযরত ঈসা (আ) তাঁর শাগরিদদের সামনে বললেনঃ আমার শাগরিদদেরই একজন (পরবর্তী সময়ে দেখা গেল ইয়াহুদী ইসকার ইউতি সেই শাগরিদ) ৩০ টি মুদ্রার বিনিময়ে আমাকে শত্রুদের কাছে বিক্রি করে দেবে । তারপরে বললেনঃ “আমার দৃঢ় বিশ্বাস , যে আমাকে বিক্রি করবে এরপর সে-ই আমার নামে মারা যাবে । কেননা, খোদা আমাকে পৃথিবী থেকে উপরে উঠিয়ে নেবেন এবং সেই বিশ্বাসঘাতকের চেহারা এমনভাবে পরিবর্তিত করে দেবেন যে, সবাই মনে করবে সে-ই আমি । তথাপি সে যখন জঘন্য মৃত্যুবরণ করবে তখন একটা সময়-কাল পর্যন্ত লাঞ্ছন আমারই হতে থাকবে । কিন্তু খোদার পবিত্র রাসূল মুহাম্মাদ যখন আসবে তখন সেই বদনাম দূর করে দেয়া হবে । আল্লাহ তা’আলা তা এ জন্য করবেন যে, আমি সেই মাসীহর সত্যতা স্বীকার করেছি । সেজন্য তিনি আমাকে এই পুরস্কার দেবেন । লোকে জানতে পারবে আমি বেঁচে আছি এবং সেই লাঞ্ছনাকর মৃত্যুর সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই । “ (অধ্যায়-১১৩)

“(হযরত ঈসা শাগরিদদের বললেনঃ) আমি সন্দেহাতীতভাবে তোমাদের বলছি , যদি মূসার গ্রন্থের সত্যতা বিকৃত না হতো তাহলে খোদা আমাদের পিতা দাউদকে অন্য একখানি গ্রন্থ দিতেন না । আর দাউদের গ্রন্থের মধ্যে যদি বিকৃতি ঘটানো না হতো তাহলে খোদা আমাকে ইনযিল দিতেন না । কারণ, মহাপ্রভু, আমাদের খোদা পরিবর্তিত হওয়ার নন । আর তিনি সব মানুষকে একই বাণী দিয়েছেন । তাই যখন আল্লাহর রাসূল আসবেন এ সব জিনিসকে পরিষ্কার করে দেয়ার জন্যই আসবেন যা দিয়ে খোদাহীন লোকেরা আমার কিতাবকে কলুষিত করে ফেলেছে । “(অধ্যায়-১২৪)

এসব সুস্পষ্ট এবং বিস্তারিত ভবিষ্যদ্বাণীতে শুধু তিনিটি বিষয় এমন দেখা যায় আপাতঃ দৃষ্টিতে খটকা লাগায় । এক, এসব ভবিষ্যদ্বাণীতে এবং বার্নাবাসের ইনজীলের আরো কিছু বাক্যে হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম নিজের মাসীহ হওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করেছেন । দুই, শুধু ওপরে উদ্ধৃত বাক্যসমূহে নয় বরং এ সুসমাচারের বহুস্থানে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মূল আরবী নাম ‘মুহাম্মাদ’ লেখা হয়েছে । অথচ পরবর্তীকালে আসবেন এমন কোন পবিত্র ব্যক্তি ও সত্তার মূল নাম উল্লেখ করা নবীদের ভবিষ্যদ্বাণীর সাধারণ নিয়ম বা রীতি নয় । তিন, এতে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে ‘মাসীহ’ বলা হয়েছে ।

প্রথম সন্দেহের জবাব হলো, শুধু বার্নাবাসের সুসমাচারেই নয়, বরং লূক লিখিত সুসমাচারেও এ বিষয়ের উল্লেখ আছে যে হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম তাঁকে ‘মাসীহ’ বলতে তাঁর শাগরিদদের নিষেধ করেছিলেন । লূকের ভাষা হলোঃ “তিনি তাহাদিগকে কহিলেন , কিন্তু তোমরা কি বল, আমি কে? পিতার উত্তর করিয়া কহিলেন, ঈশ্বরের সেই খ্রীষ্ট । তখন তিনি তাহাদিগকে দৃঢ়রূপে বলিয়া দিলেন ও আদেশ করিলেন , একথা কাহাকেও বলিও না । (অধ্যায়-৯ পদ ও ২২) সম্ভবত এর কারণ ছিল এই যে, বনী ইসরাঈল জাতি যে মাসীহর আগমনের অপেক্ষায় ছিল তাঁর সম্পর্কি তাদের ধারণা ছিল তিনি তরবারির জোরে ন্যায় ও সত্যের দুশমনের পরাচিত করবেন । তাই হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম বলেছেন, আমি সেই ‘মাসীহ’ নই । তিনি আমার পরে আসবেন ।

দ্বিতীয় সন্দেহের জবাব হলো, বার্নাবাসের সুসমাচারের যে ইটালিয়ান অনুবাদ বর্তমানে পাওয়া যায় তাতে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নাম ‘মুহাম্মাদ’ লিখিত আছে । কিন্তু একথা কেউ-ই জানে না যে, এ গ্রন্থ কোন কোন ভাষায় অনুবাদের অনুবাদ হয়ে অবশেষে ইটালিয়ান ভাষায় পৌঁছেছে । একথা সুস্পষ্ট যে, বার্নাবাসের মূল সুসমাচারের গ্রন্থখানা সুরিয়ানী ভাষারই হওয়ার কথা । কারণ হযরত ঈসা (আ) এবং তার অনুসারীদের ভাষা ছিল সুরিয়ানী । সেই মূল গ্রন্থখানা পাওয়া গেলে জানা যেতো, তাতে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পবিত্র নাম কি লেখা হয়েছিলো । এখন যতটুকু অনুমান করা যায় তা হলো হযরত ঈসা আলাইহিস ওয়া সাল্লাম হয়তো মূল শব্দ ব্যবহার করেছিলেন مُنْحَمَنَّا (মুনহামান্না) যোহন লিখিত সুসমাচারের বরাত দিয়ে ইবনে ইসহাক যা বর্ণনা করেছেন । অতপর অনুবাদকারীরা হয়তো নিজ নিজ ভাষায় তার অনুবাদ করেছেন । এরপর কোন অনুবাদক হয়তো মনে করেছেন, ভবিষ্যদ্বাণীতে আগমনকারীর যে নাম বলা হয়েছে তা পুরোপুরি ‘মুহাম্মাদ’ শব্দের সমার্থক । তাই তিনি নবীর (সা) পবিত্র এই নামটিই লিখে দিয়েছেন । অতএব এ নামটির স্পষ্ট উল্লেখ থাকাই এরূপ সন্দেহ পোষনের জন্য মোটেই যথেষ্ট নয় যে, বার্নাবাসের গোটা সুসমাচারটাই কোন মুসলমানের নকল রচনা ।

তৃতীয় সন্দেহের জবাব হলো, ‘মাসীহ’শব্দটি মূলত একটি ইসরাঈলী পরিভাষা । কুরআন মজীদে কেবল হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের জন্য এই পরিভাষাটি বিশেষভাবে ব্যবহার করা হয়েছে । কারণ, ইহুদীরা তাঁর ‘মাসীহ’ হওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করতো । মূলত এটি কুরআন মজীদের কোন পরিভাষা নয় । আর কোরআন মজীদের কথাও এটিকে ইসরাঈলীদের পারিভাষিক অর্থে ব্যবহার করা হয়নি । তাই রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ক্ষেত্রে হযরত ঈসা আলইহিস সালাম যদি ‘মাসীহ’শব্দটি ব্যবহার করে থাকেন, আর কুরআনে তাঁর জন্য এ শব্দটি ব্যবহার না করা হয়ে থাকে তাহলে তার অর্থ এই নয় যে, বার্নাবাসের সুসমাচার তাঁর সাথে এমন কিছু সম্পর্কিত করছে যা কুরআন অস্বীকার করে । আসলে বনী ইসরাঈল জাতির মধ্যে প্রাচীন কাল থেকে একটা প্রথা চলে আসছিলো । প্রথমটি হলো, কোন বস্তু কিংবা ব্যক্তিকে যখন কোন পবিত্র উদ্দেশ্য নির্দিষ্ট করা হতো তখন সেই বন্তু বা ব্যক্তির মাথার ওপর তেল মেখে দিয়ে তাকে আনুষ্ঠানিকভাবে সেই উদ্দেশ্যে নিবেদিত করা হতো । ইবরানী (ইব্রিয়) ভাষায় তেল মাখার এই কাজকে ‘মাসহ”বলা হতো । আর যে বস্তু বা ব্যক্তির ওপর তো মেখে দেয়া হতো তাকে ‘মাসীহ’ বলা হতো । উপাসনালয়ের পাত্রসমূহ এভাবে মুছে বা মর্দন করে উপাসনার জন্য নির্দিষ্ট করা হতো । যাজক ও পুরোহিতদের পৌরহিত্যের ( Priesthood ) আসনে সমাসীন করার সময়ও ‘মাসহ’ করা হতো । বাদশাহ এবং নবীকেও যখন খোদার তরফ থেকে বাদশাহী বা নবুওয়াতের জন্য নিয়োগ করা হতো তখন ‘মাসহ’ করা হতো । সুতরাং বাইবেলের বর্ণনা মতে বনী ইসরাঈল জাতির ইতিহাসে বহু ‘মাসীহ’র সন্ধান পাওয়া যায় । পুরোহিত হিসেবে হযরত হারুন ‘মাসীহ’ ছিলেন । হযরত মূসা যাজক এবং নবী হিসেবে , তালূত বাদশাহ হিসেবে , হযরত দাউদ বাদশাহ এবং নবী হিসেবে, মালেক সাদক বাদশাহ এবং যাজক হিসেবে এবং হযরত “আল-ইয়াসা” নবী হিসেবে “মাসীহ” ছিলেন । পরবর্তীকালে কাউকে তেল মেখে দিয়ে নিবেদিত করার প্রয়োজনও ছিল না । বরং আল্লাহর তরফ থেকে কারো আদিষ্ট হওয়াই ‘মাসীহ’ হওয়ার সমার্থক হয়ে গিয়েছিল । উদাহরণ হিসেবে রাজলী-১ এর ১৯ অধ্যায় দেখুন । এতে বলা হয়েছে যে, খোদা হযরত ইলিয়াসকে (এলিয়) আদেশ করলেন, তুমি, ইসরায়েলকে ‘মাসহ’ কর, সে আরামের (দামেশক) বাদশাহ হিসেবে অভিষিক্ত হোক এবং নিমশির পুত্র যেহুকে ইসরাঈলের উপরে রাজপদে অভিষেক কর । আর আমার স্থলাভিষিক্ত নবী হওয়ার জন্য ইলীশায়কে (আল ইয়াসা) অভিষেক কর । তাদের কারো মাথায়ই তেল মর্দন করা হয়নি । খোদার পক্ষ থেকে তাঁর আদিষ্ট হওয়ার সিদ্ধান্ত শুনিয়ে দেয়াই যেন তাকে ‘মাসীহ’ বা অভিষেক করার শালিম ছিল । অতএব ইসরাঈলী ধ্যান-ধারণা অনুসারে ‘মাসীহ’ শব্দটি মূলত আল্লাহর পক্ষ থেকে আদিষ্ট হওয়ার সমার্থক ছিল । হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ক্ষেত্রে শব্দটিকে এ অর্থেই ব্যবহার করেছিলেন । (ইসরাঈলীদের দৃষ্টিতে “মাসীহ” শব্দটির অর্থ কি তার বুঝার জন্য দেখুনঃ সাইক্লোপেডিয়া অব বাইবেলিক্যাল লিটারেচার, শব্দ “মিস্ইয়াহ”) ।


Download only text (no formatting) - Link


Download PDF (Recommended) - Link 



See original link :  Link



=======================================================================
( TO SUPPORT THE EDITOR , PLEASE CLICK ADS BY GOOGLE ON THIS PAGE, THANKS)

=======================================================================

Aucun commentaire:

Enregistrer un commentaire

Post Top Ad

Connect with us

More than 600,000+ are following our site through Social Media Join us now  

Youtube Video

Blog Stat

Sparkline 3258645

نموذج الاتصال

Nom

E-mail *

Message *

About the site

author Bangla Islamic" Bangla Islamic is the top Bangla Islamic Blog where you will get all information about Islamic news.

Learn more ←